লবিস্ট নিয়োগের বাকযুদ্ধের মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের চারটি চিঠি প্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল সে সময়ের কংগ্রেসম্যান নিতা লোয়ি ও লিন্ডসে গ্রাহামকে একটি চিঠি দেয়া হয়। এতে তিনি বাংলাদেশকে দেয়া বৈদেশিক সহায়তা পর্যালোচনার অনুরোধ করেন। ওই চিঠি প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব সময়ের আলোকে বলেন, প্রথমতো আমার চিঠিতে আমি কোথাও বলিনি অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার কথা। অর্থ সহায়তা বন্ধ করা আর অর্থ সহায়তা পর্যালোচনা করা কিন্তু এক কথা নয়।

বুধবার বিকেলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, এসব চিঠি বিষয়ে আমি মঙ্গলবার পরিষ্কার বক্তব্য দিয়েছি। সংবাদ সম্মেলনে আপনাদের বিস্তারিত বলেছি। চিঠি দেখানোর কি আছে? এগুলো তো ওয়েবসাইটেই আছে। তবে কোন ওয়েবসাইটে আছে তা পরিষ্কার করেননি ফখরুল। তিনি বলেন ‘তথ্যমন্ত্রী যা বলেছেন সবই কি সঠিক? তারা তো কতো কিছুই বলছে। শুনেন এমন চিঠি এর আগেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। এসব এখন বলে লাভ নেই’।

এই চিঠিতে আর যা যা বলা হয়েছে-

ফখরুল লেখেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবনতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের পদক্ষেপের আহ্বান জানানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। যেহেতু বর্তমান ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকার একটি কর্তৃত্ববাদী, একদলীয় শাসনের পথে হাঁটার পরিকল্পনা করছে, আমরা সম্মানের সঙ্গে কংগ্রেশনাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েটরদেরকে বাংলাদেশে মার্কিন সহায়তা ও বৈদেশিক সহায়তা পর্যালোচনা করার জন্য তত্ত্বাবধান ক্ষমতা প্রয়োগ করার আহ্বান জানাই।

ফখরুলের চিঠিতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধের আহ্বান

 

বাংলাদেশকে দেয়া সহায়তা পুনর্বিবেচনা করতে ফখরুলের চিঠির প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা হয়, ‘এটা জরুরি যে কংগ্রেশনাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েটররা সতর্কতার সঙ্গে ও কৌশলীভাবে এ পন্থা ব্যবহার করে আমেরিকার অত্যাবশ্যক জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ক্ষেত্রে এমনভাবে সুরক্ষিত করবেন যা বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের কঠোর নেতৃত্বের অধীনে ক্রমাগত খারাপ হতে থাকা পরিস্থিতির উন্নতিতে অবদান রাখে।’

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ’ বলেও উল্লেখ করেন বিএনপি মহাসচিব। বলেন, ‘নির্বাচনের পর, দেশে গণতন্ত্রের অবনতি যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ ও এর প্রতি অসন্তোষ অব্যাহত রেখেছে। ইউএস এক্সিকিউটিভ ব্রাঞ্চ, সশস্ত্র বাহিনী ও কংগ্রেস ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব ও মানবাধিকারের অপব্যবহারের বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে:

স্টেট ডিপার্টমেন্টের সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক হিউম্যান রাইটস রিপোর্টে বাংলাদেশের উপর ৫০ পৃষ্ঠার একটি কঠোর প্রতিবেদন রয়েছে। প্রতিবেদনে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ও বলা হয়েছে যে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ ডিসেম্বরে এমন একটি ব্যাপকভাবে একতরফা সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয় পাঁচ বছরের মেয়াদে জয়লাভ করেছে যেটি অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না ও যেখানে ব্যালট বাক্স ভর্তি, বিরোধী পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোর মতো বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ছিল’।

 

আর্মড সার্ভিসেস কমিটির সামনে সিনেটের সাক্ষ্যে ইউএস ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল ফিলিপ এস ডেভিডসন, উল্লেখ করেছেন যে ‘বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ক্ষমতা একত্রীকরণের প্রবণতার জানান দেয় ও এতে আশঙ্কা জেগেছে যে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা একটি একদলীয় রাষ্ট্র অর্জনের লক্ষ্যে রয়েছেন।

পররাষ্ট্র বিষয়ক হাউস কমিটি পররাষ্ট্র সচিব পম্পেওকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের হুমকি মোকাবেলায় ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি দ্বিপাক্ষিক চিঠি পাঠিয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারকে সমর্থন করা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে এগিয়ে নেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম সেই গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থগুলিকে গুরুতরভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে৷’

বাহ্যিক চাপ সত্ত্বেও, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার শাসনকে সুসংহত করতে এবং নাগরিক স্বাধীনতা ও বিরোধী কণ্ঠস্বরের উপর আক্রমণ চালিয়ে যেতে চায় বলেও অভিযোগ করেন ফখরুল। বলেন, ‘অধিকন্তু চলমান রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা আরও খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। কারণ জাতিসংঘ সম্প্রতি শরণার্থীদের একটি উপকূলীয় দ্বীপে স্থানান্তর করার সরকারের পরিকল্পনার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সতর্ক করেছে যে ‘সংশ্লিষ্ট উদ্বাস্তুদের সম্মতি ছাড়া অপরিকল্পিত স্থানান্তরে নতুন সংকট সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।’

 

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তদন্তের আহ্বানে মিট রমনি ও জেমন রিসকের কাছে দুই চিঠি প্রেরণ করা হয়। চিঠিগুলোর ভাষাও হুবহু এক।

এতে ফখরুল লেখেন, ‘বাংলাদেশে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য একটি স্বাধীন তদন্তের গুরুত্ব ও এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোনো অর্থবহ পদক্ষেপের অভাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও, কোনো তদন্ত হয়নি ও তদন্তের কোনো পরিকল্পনাও জানানো হয়নি।

‘যেহেতু বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল কর্তৃত্ববাদী, একদলীয় শাসনের দিকে ধাবিত হওয়ার পরিকল্পনা করছে, আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের প্রশ্ন উত্থাপন করার জন্য অনুরোধ করছি যাতে একটি স্বাধীন তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক আহ্বানগুলির দিকে মনোযোগ দেয়া হয়।’

ফখরুলের চিঠিতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধের আহ্বান

ইউএস ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের পরিপ্রেক্ষিতে, গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের প্রতি সমর্থন আমেরিকান স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলেও উল্লেখ করেন ফখরুল। লেখেন, ‘যা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এর অভাব ও এর জবাবদিহিতার অব্যাহত অভাবের কারণে হুমকির সম্মুখীন।’

ফখরুল লেখেন, নির্বাচনের পরে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিবৃতির মাধ্যমে প্রকাশ্যে একটি স্বাধীন তদন্ত ও নিরপেক্ষ পরীক্ষার জন্য আহ্বান জানায় যা বিরোধী দলের সদস্যদের উপর আক্রমণ, ভোটারদের ভয় দেখানো, ভোট কারচুপি ও ব্যালট বাক্স ভরা এবং নির্বাচনের আগে ও চলাকালীন নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণের স্বীকৃতি দেয়।’

একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নও তুলে ধরেন ফখরুল। তিনি লেখেন:

 

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট উল্লেখ করেছে ‘প্রাক-নির্বাচন সময়ে হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন যা অনেক বিরোধী প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের জন্য দেখা করা, সমাবেশ করা ও অবাধে প্রচার করা কঠিন করে তোলে (এবং) নির্বাচনের দিনের অনিয়ম কিছু লোককে ভোট দিতে বাধা দেয়, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ন করেছে।’

স্টেট ডিপার্টমেন্টের সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক হিউম্যান রাইটস রিপোর্টে বাংলাদেশের উপর ৫০ পৃষ্ঠার একটি কঠোর প্রতিবেদন রয়েছে। প্রতিবেদনে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ও বলা হয়েছে যে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ ডিসেম্বরে এমন একটি ব্যাপকভাবে একতরফা সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয় পাঁচ বছরের মেয়াদে জয়লাভ করেছে যেটি অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না ও যেখানে ব্যালট বাক্স ভর্তি, বিরোধী পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোর মতো বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ছিল।

পররাষ্ট্র বিষয়ক হাউস কমিটি পররাষ্ট্র সচিব পম্পেওকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের হুমকি মোকাবেলায় ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি দ্বিপাক্ষিক চিঠি পাঠিয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারকে সমর্থন করা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে এগিয়ে নেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম সেই গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থগুলিকে গুরুতরভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে।’